লিলির কীর্তি
একবার লিলি বুদ্ধি খাটিয়ে একটা সমস্যার সমাধান করেছিল। একটা চুরির কিনারা করেছিল। সে প্রায় দু বছর আগেকার কথা। তারপর থেকে লোকমুখে ঘটনাটা ছড়িয়ে গেছে। আর আত্মীয়স্বজনেরা সবাই লিলির বুদ্ধির তারিফ করেছে। বাবা তখন কর্মসূত্রে জলপাইগুড়ি ছিলেন। এখন বদলি হয়ে এসেছেন মেদিনীপুর শহরে। আমি খুকু, এখন পড়ি ক্লাস টেন-এ, বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠে। আমার ভাই টুকাই পড়ে ক্লাস সিক্সে। আর মা সারাদিন সংসার সামলান।
ভাবছ তো লিলি কে? লিলি আমার পিসি, আমার থেকে মাত্র কয়েক বছরের বড়। লিলির সত্যিই খুব বুদ্ধি। কোঁকড়া চুল দিয়ে ঘেরা মুখখানিতে চোখদুটো জ্বলজ্বল করে। লিলির মতে চোর ধরাটা কোন কঠিন ব্যাপার নয়। শুধু তার জন্য দরকার একটু বুদ্ধি আর সাহস। লিলির ধারণা, এ দুটোই তার আছে।
লিলি ইতিহাসে ভালভাবে এম এ পাশ করে বেকার হয়ে বসে আছে আর চাকরির চেষ্টা করছে। বাবা লিলিকে বলেছেন হস্টেলে না থেকে এখন কিছুদিন আমাদের কাছেই থাকতে।
এরকম একটা সময়ে আমরা একদিন রিমামাসির মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্নের চিঠিটা পেলাম। উনি মার নিজের দিদি, আমার আপন মাসি। পাপড়ি দিদি রিমামাসির একমাত্র মেয়ে, দেখতে খুব মিষ্টি। ওরই বিয়ে। মাসিরা কলকাতার সল্টলেক অঞ্চলে থাকেন। চিঠিতে বারবার যাবার কথা লিখেছেন।
চিঠিটা পেয়েই আমি খুশিতে লাফাতে শুরু করলাম। বিয়ের আর তিন সপ্তাহ বাকি। ঠিক হল আমরা সবাই মিলে কলকাতায় যাব বিয়ের ক’দিন আগে। সঙ্গে লিলিও যাবে। মার বাপের বাড়ির সকলেই লিলিকে ভালভাবে চেনেন। আর তাঁরা লিলির গানও বেশ পছন্দ করেন, বিশেষত নজরুলগীতি ও ভজন। বলা বাহুল্য আমি লিলির একজন অনুগত ভক্ত ও গানের বিশেষ সমঝদার। তাই সবসময়ে ওর সাথে থাকি।
বিয়ের দিন চারেক আগে বাবা আমাদের সবাইকে নিয়ে কলকাতা রওনা হলেন। রিমামাসিদের নতুন বাড়ি দেখে আমরা সবাই তাজ্জব বনে গেলাম। এর আগে মাসিরা বেহালায় অনেক ছোট বাড়িতে থাকতেন। মার মুখে শুনেছি যে রমেন মেসোর ব্যবসা খুব ভালো চলাতে, তাঁরা এতবড় বাড়ি কিনতে পেরেছেন সল্টলেকে।
বাড়িটা বিশাল বড়। উপরে পাঁচখানা ঘর আর প্রতি ঘরের সাথে লাগোয়া বাথরুম। নিচের তলায় বসার ঘর, খাবার ঘর, রান্নাঘর আর দুটো শোবার ঘর। দুটো ঘরের সাথে লাগোয়া দুটো বাথরুম। প্রতি তলাতেই সামনে পিছনে চওড়া বারান্দা। একতলায় ওই দুই বারান্দার পরে বড় উঠান আর তারপর বড় ফুলফলের বাগান। উপরের দুই বারান্দা থেকে সামনের আর পিছনের বাগান চমৎকার দেখা যায়। বাগানের শেষে নিচু পাঁচিল বাড়িটাকে ঘিরে রয়েছে। বাগানে পাঁচিলের ধার ঘেঁষে জায়গায় জায়গায় রয়েছে পাতাবাহারের ঘন ঝোপ।
আমরা এসে দেখি, পাপড়ি দিদির দুই পিসি আগেই এসে গেছেন। এঁরা অনেক দূরে থাকেন। একজন পাটনায়, অন্যজন ভাগলপুরে। তারপর আসতে শুরু করলেন অন্যান্য আত্মীয়স্বজন। তার মধ্যে আমার ছোট মাসি, বড়মামা এবং মামাতো দাদা-বৌদিও আছেন। হইচই আর কথাবার্তায় বিয়েবাড়ি একেবারে সরগরম হয়ে উঠল।
আমরা থাকবার জন্য একতলায় একটা পুরো ঘর পেয়ে গেলাম। অনেকের জন্য উপরে ব্যবস্থা করা হল। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলেই প্রথমে মণিপিসির ঘর। তার পাশে থাকবেন মামাতো দাদা আর রেবা বৌদি। তার পরের ঘরগুলিতে থাকবেন মামা, ছোট মাসি ও আরেক পিসি, তাঁদের পরিবারের সঙ্গে। বাকি আত্মীয়রা থাকবেন কাছাকাছি হোটেলে। এক কথায় ব্যবস্থা চমৎকার।
বিয়ের দুদিন আগে ফুল সাজানোর লোক এসে অর্ডারটাকে পাকা করে গেল। তারপরে এলো বিয়ের দিনের ক্যাটারার। সে-ও তাই। বিয়ের আগের দিনও সে খাবার সাপ্লাই করবে। আলাদা বিয়ে বাড়ি আর ভাড়া করা হয়নি। বিয়ে ওই বাড়ির একতলাতেই হবে। ছাদে খাওয়া-দাওয়া। গেটে বসবে নহবতের আসর। মামা আর রমেন মেসো সেই ব্যবস্থা পাকা করতে গেছেন। বিয়ের দিন সকাল থেকে সানাই বেজে উঠবে। রিমামাসি চারদিক তদারক করতে করতে আর কনের শাড়ি-গয়না দেখাতে দেখাতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন।
দুপুরে মালিদাদা রামু হঠাৎ এসে জানাল যে সে দশ দিনের ছুটি নিয়ে দেশে যেতে চায়। তার বউ গুরুতর অসুস্থ। বিয়ের আগে ছুটি! কিন্তু কিছু করার নেই, ছুটি দিতেই হল।
সেদিন সন্ধ্যাবেলায় বসল গানের আসর। অনেকেই গান গাইবেন। অবশ্য, এই ‘অনেকের’ মধ্যে আমিও আছি। তবে মূল গায়িকা লিলি-ই।
প্রথমে একটা নজরুলগীতি গেয়ে লিলি আসর জমিয়ে তুলল। দ্বিতীয় গান, মীরার ভজন, শুরু করতে যাবে—এমন সময় একটা বাধা পড়ল।
আমার মামাতো বৌদি রেবা ঘরে ঢুকে কান্নাভেজা গলায় ডাকল ‘বেলুপিসি, একটু শোন এদিকে!’ বৌদির মুখ গম্ভীর, চোখ ছলছল। বলতে ভুলে গেছি যে লিলির ডাকনাম ‘বেলু’। আমি ‘লিলি’ বলে ডাকি।
লিলিকে নিয়ে বৌদি বাইরে বেরিয়ে এসে বলল ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে, বেলুপিসি! দুপুরে মণিপিসির সুটকেস থেকে গয়না চুরি গেছে। আর ওরা আমাকে এই ব্যাপারে সন্দেহ করছে। বিশ্বাস করো, এই চুরির বিন্দুবিসর্গও আমি জানিনা। আমাকে বাঁচাও বেলুপিসি।’ এই বলে বৌদি কাঁদতে লাগল।
বৌদি দুর্গাপুরে থাকে আর তার অবস্থাও বিশেষ ভাল নয়। তাই তাকে সন্দেহ করা খুব সহজ। বৌদির ঘর মণিপিসির ঘরের পাশেই। যাই হোক, চুরির ঘটনাটা এবার লোকমুখে খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে গেল। রমেন মেসো সবাইকে জিনিসপত্র খুব সাবধানে সামলে রাখতে বললেন। উৎসবমুখর বাড়িতে হঠাৎ আনন্দের সুর কেটে গিয়ে, বিষাদের ছায়া ছড়িয়ে পড়ল।
ঘটনাটা ধীরে ধীরে জানা গেল। মণিপিসি দুপুর বারোটায় স্নান করার জন্য বাথরুমে গিয়েছিলেন। গয়নার বাক্সটা সুটকেসে কাপড়ের ভাঁজে রাখা ছিল। সুটকেসটা বন্ধই ছিল, তবে তাতে তালা দেওয়া ছিল না, আর ভুলবশত তার চাবিটা লাগানো ছিল সুটকেসে। ঘরের দরজা ভেজানো থাকলেও বারান্দার দিকের একটা জানালা খোলা ছিল। ঘরে পিসেমশাই ছিলেন না, ছিল না ওঁদের ছেলে বাবাইও। চতুর চোর এই সুযোগে সুটকেস থেকে গয়নার বাক্সটা সরিয়ে ফেলেছে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে সুটকেসের ডালা খোলা দেখে পিসি চমকে ওঠেন। তাড়াতাড়ি খুঁজতে গিয়ে দেখেন যে বাক্সটা উধাও। ঘরের দরজাও খোলা ছিল।
সবাই লিলিকে ধরে বসল ঘটনাটার ফয়সালা করতে। লিলি বলল, ‘বেশ, দেখছি কি করা যায়! তবে ঘটনাটার তদন্ত করতে হলে সবাইকেই জেরা করতে হবে। এজন্য আপনাদের অনুমতি প্রয়োজন।’ বলা বাহুল্য, অনুমতি মিলল।
রাত হয়ে গেছিল। খেয়ে দেয়ে আমরা সবাই শুতে চলে গেলাম। যাবার আগে রমেন মেসো লিলিকে ডেকে বললেন, ‘দেখ বেলু, এমন বিশ্রী ঘটনাটা আমার বাড়িতেই ঘটল! তাও আমার মেয়ের বিয়ের আগে! আমি মণিকে গয়নার পুরো দাম দিয়ে দেব। নাহলে আমার মেয়ের অকল্যাণ হবে।’
লিলি বলল, ‘রমেনদা, আমি যখন ভার নিয়েছি, তখন দেখিই না কি করতে পারি। আমাকে শুধু কয়েকটা দিন সময় দিন। ততদিন চুপচাপ থাকুন।’
রাতে খাটে শুয়ে লিলি আমাকে বলল, ‘দ্যাখ খুকু, আপাত দৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও, কেসটা বেশ জটিল। কি করে এগোব, বুঝতে পারছিনা। তাছাড়া, সবাই তো আমার চেনা। কাকে আমি চুরির দায়ে অভিযুক্ত করি বল!’ এই বলে ভুরু কুঁচকে সে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। আমার একটুও ভাল লাগছিল না। তাই ঘুমোনোর আগে ভগবানকে মনে মনে বললাম, ‘হে ঠাকুর, লিলি যেন সফল হয়! তুমি একটু সাহায্য কর।’
পরদিন শত ব্যস্ততার মধ্যেও মনে হল আনন্দমুখর বাড়িটা যেন ঝিমিয়ে পড়েছে – হয়তো কিছুটা চুরির কারণে। আর বিয়ের পর মেয়ে চলে যাবে অন্য বাড়িতে – সেজন্যেও। এদিকে সকালে জলখাবারের পর একটা ঘরে বসে লিলি তার জেরা শুরু করল। পাশে বসে আমি সব শুনছি। আত্মীয়স্বজনদের জেরা শেষ হবার পর, চাকর-বাকরদের জেরা শুরু হল। রিমামাসিদের দুজন চাকর, একজন ঝি। সদানন্দ চাকর গোটা বাড়ির তদারক করে, ফাইফরমাশ খাটে। ঝি মিনাকে আমরা ছোটরা ‘মিনা মাসি’ বলে ডাকি। সে দুবেলা সারা বাড়ি মোছামুছি করে, আসবাবপত্র ঝাড়ে, কাপড় ধোয় ইত্যাদি। আর রয়েছে পাচক ঠাকুর গোপাল। রান্নাঘরের যাবতীয় কাজ সে করে – জলখাবার বানানো থেকে দুবেলা রান্নাও। সবাই ওই বাড়িতেই থাকে।
জেরায় জেরায় যে তথ্য বেরিয়ে এল, তা হল এই। ঘটনার সময় বেশির ভাগ আত্মীয়ই উপরে ছিলেন না। রেবা বৌদি উপরের ঘরে বিশ্রাম নেবার পর, স্নানের উদ্যোগ করছিল। মামাতো দাদা ঘরে ছিলেন না। চাকরেরা সারা দুপুর প্রয়োজনে উপর নিচ করেছে। আর মিনামাসি আমার ছোটমাসির মাথা টিপতে গেছিল কিছুক্ষণের জন্য। ছোটমাসি মাথাধরায় কষ্ট পাচ্ছিলেন। বিয়েটা হয়ে গেলে চাকরবাকরেরা পালা করে কিছুদিনের জন্য দেশে ঘুরে আসবে।
জেরা শেষ হলে লিলি বলল, ‘ঘটনার পুরো তদন্ত করতে হলে, সবার সুটকেস, জিনিস পত্র আমাকে দেখতে দিতে হবে।’ তাই-ই হল। কিন্ত কারোর ঘরে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেল না। এমন কি ঝি-চাকরদের ঘরেও নয়।
এসব করতে করতে দুপুর গড়িয়ে গেল। আমরা তাড়াতাড়ি স্নান-খাওয়া সেরে নিলাম। বিশ্রাম নেবার আগে বাবা আর রমেন মেসোকে ডেকে লিলি খুব নিচু গলায় বলতে লাগল, ‘মেজদা, রমেনদা একটা কাজ করতে হবে। এই চার-পাঁচদিন বাড়ির সবার উপর নজর রাখতে হবে। বাড়ির চারপাশে, যেমন বাগান আর পাঁচিলের উপরও কড়া নজর রাখা দরকার। খুকু, বাবাই আর সন্তুর উপর এ কাজের ভার দিলাম। আমার বিশ্বাস, গয়নাগুলো এখনও বাড়িতেই আছে।’ সন্তু পাপড়ি দিদির আরেক পিসতুতো ভাই- ছোট পিসির ছেলে।
আমি বললাম, ‘পাঁচিলের কথা বলছ কেন?’ লিলি বলল, ‘পাঁচিলটা খুব নিচু। তাই সেটা টপকানো কোন মানুষের পক্ষে কঠিন নয়।’
পরের দিন বিয়ে। ছোট ছোট টুনি বাল্ব দিয়ে গোটা বাড়িটা সাজানো হয়েছে। সন্ধ্যে হলে বাড়িটা আলোর মালায় সেজে উঠবে। ডেকরেটার এসে নহবত আর বিয়ের মণ্ডপও সাজিয়ে গেছে। বিয়ের দিন সকাল থেকে ফুল দিয়ে বাড়ি সাজানো চলল। দুপুরে পাপড়ি দিদির গায়ে-হলুদ নির্বিঘ্নে হয়ে গেল। তারপর খাওয়া দাওয়া। বরপক্ষের লোকেরা, যারা গায়ে-হলুদের তত্ব এনেছিল, তারা সবাই মিষ্টি খেয়ে বিদায় নিল।
পাপড়ি দিদির কাছে বরের ছবি দেখলাম। রাজপুত্রের মতো চেহারা। বিয়ের পর ওরা ক্যালিফোর্নিয়া চলে যাবে। ওখানেই বর চাকরি করে এক কম্পিউটার কোম্পানিতে।
সকাল থেকে নহবতের আসর বসেছে। সন্ধ্যেবেলা আত্মীয়-অভ্যাগতদের সমাগমে বাড়ি গমগম করে উঠেছে। রিমামাসি ও মেসো, অভ্যাগতদের আপ্যায়ন করতে করতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন। সঙ্গে আছেন মামা, মাসি আর পিসিরা।
এরই এক ফাঁকে লিলি আমাকে চুপিচুপি বলল, ‘শোন খুকু, বিয়ে দেখার সাথে সাথে তোরা চারদিকে নজর রাখবি। সন্দেহজনক কিছু দেখলেই আমাকে জানাবি। আমিও নজর রাখব।’
সেদিন সন্দেহজনক কিছু ঘটল না। নির্বিঘ্নে বিয়ে সমাধা হল।
পরের দিন সকালে পাপড়ি দিদি চোখের জলে বিদায় নিল। সবার চোখে জল। নববধূর সাজে দিদিকে যে কি সুন্দরই না দেখাচ্ছিল! ঠিক যেন রাজকন্যা! রাজপুত্রের মতো দেখতে জামাইদাদা পাশে দাঁড়িয়েছিল।
পাপড়িদিদি চলে গেলে, মনে হল যেন ভাঙ্গা হাটে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। নহবতের আসর ভেঙ্গে গেছে, ফুলগুলো বাসি হয়ে গেছে। রমেনমেসো গয়নার ব্যাপারে হাল ছেড়ে দিয়েছেন, কিন্তু লিলি এখনও হাল ছাড়েনি। আরও তিনদিন সময় চেয়ে নিয়েছে। এই তিনদিনের মধ্যে কেউ বাড়ি যেতে পারবে না। তারপর সবাই একে একে বিদায় নেবে। কাজের লোকেদের মধ্যে মিনামাসি প্রথমে বাড়ি ঘুরে আসবে। তারপর অন্যরা।
‘আরেকটা কথা, রমেনদা’ লিলি বলল, ‘আরেকবার সবার ঘরে সার্চ করার অনুমতি দিন। সবার বাক্স-পত্রও তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখতে হবে। এত সহজে আমি পিছু হঠছি না।’
অনুমতি মিলল। কোনও এক সময় আচমকা লিলি খোঁজা শুরু করবে।
পরের তিন দিন আমরা যদিও নজর রেখেছি চারদিকে, উল্লেখযোগ্য কিছুই ঘটল না। প্রথম দিন দুপুরে বৌভাতের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে বড়রা পাপড়ি দিদির শ্বশুরবাড়ি চলে গেলেন। আমরা ছোটরা যাই নি, লিলিও না। দ্বিতীয় দিনও কাটল। বাড়ি থেকে টুনি বাল্ব সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ফলে, বারান্দাগুলিতে টিমটিমে বাতি জ্বললেও, আলোআঁধারির সৃষ্টি হয় সন্ধ্যেবেলা। তৃতীয় দিন বিকেলবেলা লিলি আচমকা সবার ঘরে হানা দিয়ে ঘর সার্চ করতে লাগল। ঝি-চাকরদের ঘরও বাদ গেল না। কিন্তু গয়নার বাক্স কোথাও মিলল না।
সেদিন রাত্রিবেলায় খাওয়া দাওয়ার শেষে উপরের বারান্দার বাতি নিভিয়ে দেওয়া হল। বারান্দার কোণে লুকিয়ে থেকে আমি আর লিলি কড়া নজর রেখেছি বাড়ির পিছনের ফুলের বাগান আর পাঁচিলের উপর। বাগানে বাড়ির আলো অল্প অল্প এসে পড়েছে নানা জায়গা থেকে। বাগানটা অবশ্য অন্ধকার, সেখানে কোন বাতি নেই।
রাত এগারোটা বাজল। আমরা বসেই আছি। হঠাৎ লিলি আমার হাত চেপে ধরে, কোনও কিছুর দিকে ইঙ্গিত করল। তাকিয়ে দেখলাম, সেই অস্পষ্ট আলোয় এক ছায়ামূর্তি খুব সন্তর্পণে বাগানের মধ্য দিয়ে পাঁচিলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু না, পাঁচিল সে ডিঙ্গালো না। বরং, পাঁচিলের এপাশে সে কিছু যেন খুঁজতে লাগল। কাজ শেষ করে সে যখন এদিকে ফিরছে, তখনই লিলির হুইসিল বেজে উঠল আর গোটা বাড়ির আলো জ্বলে উঠল। লিলির হাতের টর্চের জোরালো আলো এসে পড়ল চোরের মুখের উপর। আরে, এ যে কালো চাদরে ঢাকা মিনা মাসি, হাতে কাপড়ে মোড়া একটা বাক্স! ততক্ষণে হই হই করে বাড়ির লোকজন বেরিয়ে এসে মিনামাসিকে ঘিরে ধরেছে। বাবা আর রমেন মেসোকে লিলি আগেই বলে রেখেছিল।
অবশেষে চোর ধরা পড়ল। মিনামাসিকে ঘরে এনে, লিলি জেরা শুরু করল।
লিলি – ‘তুমি এ কাজ করেছ, বিশ্বাস হয় না। তুমি কত দিনের লোক, কেন একাজ করলে?’
মিনামাসি ভয়ে কাঁদতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে সে যা বলল, তার মর্মার্থ এই— ।
সে বড় গরিব। ঘরে অসুস্থ স্বামী ছাড়া তার তিন মেয়ে রয়েছে। বড় মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে, কিন্তু তার জন্য পয়সা লাগবে, গয়না লাগবে। এত সে পাবে কোথায়? তাই সে গয়না চুরি করেছে। লোভ সামলাতে পারেনি।
সবাই চুপ করে শুনছে। লিলি শুধোল, ‘কীভাবে চুরি করলে?’
মিনামাসি বলল, ‘ছোট মাসির মাথা টিপে যখন চলে যাচ্ছি, তখন জানালা দিয়ে দেখলাম যে পিসির সুটকেস থেকে চাবি ঝুলছে আর ঘরে কেউ নেই। তখন ঘরে ঢুকে বাক্সটা নিয়ে নিলাম। দোহাই দিদি, যা শাস্তি দেবেন দিন, কিন্তু পুলিশে দেবেন না।’ এই বলে সে লিলির পা জড়িয়ে ধরল।
লিলি – ‘আর একটা কথা। বাক্সটা কোথায় লুকিয়েছিলে? সব খুলে বল, তাহলে পুলিশে দেব না।’
মিনামাসি – ‘ওই দিন দুপুরে বাক্সটা আমার কাছেই ছিল। রাত্তির বেলা সবাই ঘুমলে ওটা ঝোপের পিছনে রেখে আসি। কাপড় ঢাকা ছিল, তাই কেউ সহজে বুঝতে পারবে না।’
বলাই বাহুল্য মিনামাসিকে আর কাজে বহাল রাখা হল না। কিছু টাকা দিয়ে তাকে বিদায় করা হল। পরদিন সকালেই সে চলে যাবে।
এদিকে লিলির নামে জয়জয়কার পড়ে গেল। হারানো গয়না ফিরে পেয়ে মণিপিসির খুশির সীমা রইল না। তিনি পুরস্কারস্বরূপ একটা হার লিলির গলায় পরিয়ে দিলেন। মিথ্যে অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়ে রেবাবৌদির মুখে হাসি ফুটে উঠল। সবাই খুশি, কিন্তু সব চাইতে খুশি হলেন বোধহয় বাবা। আর আমিও। লিলির গর্বে আমার বুক ভরে উঠছিল।
রাত একটা বেজে গেছিল। সবাই যে যার ঘরে চলে গেলাম। পরের দিন আমাদের অনেকেরই রওনা হবার কথা ছিল। কিন্তু রিমামাসি কাউকেই যেতে দিলেন না। তার পরদিন আমরা রওনা হব।
সকালে জমিয়ে জলখাবার-পর্ব সমাধা হবার পর রিমামাসি মা-মাসিদের সবাইকে শাড়ি দিলেন, আর লিলিকে দিলেন বিশেষ উপহার – একটা ঢাকাই জামদানি শাড়ি। তারপর সবাই লিলিকে ধরে বসল তদন্তের পুরো বিবরণ জানাতে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে লিলি শুরু করল – ‘এটা তো বোঝাই যাচ্ছিল যে বাড়ির লোকেদের মধ্যে থেকে কেউ এ কাজ করেছে, হয় আমরা আত্মীয়পরিজনরা, নয় তো কাজের লোকেদের কেউ। রেবা পাশের ঘরেই থাকে। চাকরেরা নানা কাজে সারা দুপুর উপরনিচ করেছে, মিনাদি কিছুক্ষণের জন্য মাথা টিপতে গেছিল উপরে। তাই এরা সরাসরি সন্দেহের তালিকায় পড়ে। এছাড়া, অন্য কেউও দোষী হতে পারে। তবে, এই চোর খুব সাবধান। তাই ঘরের জিনিসপত্র সার্চ করে বাক্সটা কোথাও পাওয়া যায় নি। তাহলে বাকি রইল বাগানের আশপাশ দেখা। এদিকে তিনদিনের মধ্যে তৃতীয় দিন শেষ হবে গতকালই। তার পরের দিন সবাই একে একে চলে যেতে শুরু করবে। তাই গতকাল রাতেই নজর রাখলাম বাগানের উপর। রাত্রিবেলাতেই চোর বাক্সটা নিতে আসবে। বাকিটা সবারই জানা।’
কঠিন সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়িটা আবার যেন ঝলমলিয়ে উঠেছে। দুপুরে জমিয়ে ভোজ। খাওয়া দাওয়ার শেষে রেবা বৌদি এসে কুণ্ঠিতভাবে লিলিকে রবি ঠাকুরের ‘গল্পগুচ্ছ’ উপহার দিল। তারপরে বলল, ‘বেলুপিসি, আমি তোমাকে আর কি দিতে পারি? আমার প্রিয় এই বইটাই তোমাকে দিলাম।’
পরের দিন সকালেই আমরা রওনা হব। অনেক দূরের পথ। বিদায়ের সময় রিমা মাসিরা সবাই বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছেন, এমন সময় রমেন মেসো হঠাৎ এগিয়ে এলেন। বাবার হাত দুটো ধরে অনুনয়ের সুরে বললেন, ‘ভাই অনিমেষ, বেলু আমার যে উপকার করেছে, তার তুলনা নেই। তাই আমি একটা প্রস্তাব রাখছি। বেলুর বিয়ে এ বাড়িতে থেকেই হোক! আমি যতটা পারি সাহায্য করব। তুমি ভাই অমত করো না। ওর জন্য সুপাত্র খুঁজছ তো?’
বাবা একটু হেসে বললেন, ‘সে দেখা যাবে।’ বিয়ের কথায় লিলির গালে আবিরের ছোপ লাগল। তারপর এগিয়ে এসে মেসোকে প্রণাম করে বলল, ‘রমেনদা, একটা অনুরোধ। আমি মিনাদির কথা শুধু ভাবছি। এতদিন চাকরি করেও মেয়েকে বিয়ে দেবার ক্ষমতা ওর নেই। তাই আপনি যদি মিনাদির এক মেয়ের বিয়েতে সাহায্য করতে পারেন, তাহলে খুব ভাল হয়।’
সবাই চুপ। মেসো শুধু অস্ফুটে বললেন, ‘তাই হবে, বেলু।’
আমরা এবার চলতে শুরু করলাম। গেটের কাছে গিয়ে পিছন ফিরে হাত নাড়লাম। সবাই দাঁড়িয়ে আছেন। গেট পার হয়ে বড় রাস্তায় বাঁক নিতেই আর কাউকে দেখা গেল না।